ঐতিহ্যবাহী এই গ্রন্থাগারের প্রবেশ পথের দু’পাশে বাঁশের সারি। বাঁশ ব্যবসায়ীরা দাপটের সাথে বাঁশ বিক্রি করছেন। জেলা গ্রন্থাগারের অবয়ব ঢেকে পড়ছে বাঁশের সারিতে। না প্রশাসন না পুর পরিষদের নজর রয়েছে এই পরিবেশের দিকে। অনেক সময় এই গ্রন্থাগারের সভাকক্ষে সরকারী উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক হয়। কিন্তু প্রবেশ পথের এই দৃশ্য শহরবাসীকে লজ্জায় ফেলে দেয়।

পঞ্চাশের দশক থেকে ৯০ দশকের শেষ দিক পর্যন্ত কৈলাসহর গ্রন্থাগারটি ছিল জ্ঞান ও বিনোদনের উন্মুক্ত জানালা। বিদ্যুতিন মাধ্যমের দাপটে মুদ্রণ মাধ্যমে বড় সড় আঘাত লেগেছে। তার ঝাপটা পড়েছে এই গ্রান্থাগারেও। একদিকে তথ্য প্রযুক্তির উন্নতি অন্যদিকে অবহেলা দুভাবেই আক্রান্ত এক সময়ের নিঃশব্দ পাঠকের ভিড়ে ঠাসা ঐতিহ্যের জেলা গ্রন্থাগার। কর্মচারি স্বল্পতাসহ নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত ঊনকোটি জেলা গ্রন্থাগারটি।
কৈলাসহর শহরের শতাব্দী প্রাচীন আর কে আই স্কুল মাঠ সংলগ্ন প্রাচীন এই গ্রন্থাগারটিতে বহু মূল্যবান বই সহ ৭৯ হাজার ২১৩ টি বই রয়েছে। তার মধ্যে ইংরাজী,বাংলা, হিন্দি ও ককবরক ভাষার বই রয়েছে। যদিও অযত্নে এর মধ্যে ক্ষতিগ্রস্থ বই-এর সংখ্যা প্রায় ১৭ হাজার।


বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে ২০০৭ সালে বড় পরিসরে আধুনিক সাজে সাজিয়ে তোলা হয়েছিল এই গ্রন্থাগারটিকে। শুধুমাত্র সাধারণ পাঠকদের জন্য নয়, ২০১৬ সালে বেইলি গ্রন্থাগার চালু করা হয়েছে। পরিকাঠামো সংস্কার করে সিঁড়ির পাশাপাশি রেম্প বসানো হয়েছে। সাজসজ্জা আসবাবপত্র সব ঠিকঠাক থাকলেও সরকারি কর্মী ও সাধরণ পাঠকের সংখ্যা দিন দিন কমেই চলেছে। আগামী দিনে এটি টিকে থাকবে কি না তাও এখন বড় প্রশ্ন হয়ে উঠেছে। প্রসঙ্গত বর্তমান কৈলাসহর প্রেস ক্লাবের ভবনটিতে ১৯৫৩ সালে কৈলাসহরে প্রথম গড়ে উঠে এই উত্তর ত্রিপুরা জেলা গ্রন্থাগার। ৬০ থেকে ৭০ এর দশকে জমজমাট ছিল এই গ্রন্থাগারটি। অবিভক্ত উত্তর জেলার বইপ্রেমী সংস্কৃতি মনষ্ক মানুষের বই পড়ার এক মাত্র প্রাণ ভোমরা হয়ে উঠেছিল এই গ্রন্থাগারটি। এখানে শুধুমাত্র বই পড়াই নয় জাতীয় ও রাজ্যের সব পত্রপত্রিকা পাঠ, আকাশবানীর সংবাদ শোনার সব সুবিধাই ছিল । ফলে পাঠক ছাড়াও সংবাদ শ্রোতাদের মতো এক ধরণের নাগরিকদের যাতায়াত ছিল এই গ্রন্থাগারে। অফিস স্কুল কলেজ ছুটির পর তরুন তরুনী থেকে মাঝ বয়সীদের একমাত্র ঠিকানা ছিল এটি।
এখন দায় সাড়তে মাসে দুমাসে আগরতলায় ডেকে নিয়ে দপ্তরের উদ্যোগে সভা হয়। প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হয়। এর বাইরে কেউ খোঁজ নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেন না। গ্রন্থাগারের প্রধান গ্রন্থাগারিক অরুনাংশু দাস জানান, সময়ের চাহিদা অনুযায়ী আধুনিক সুবিধাযুক্ত অনেক ব্যবস্থা রয়েছে এই জেলা গ্রন্থাগারে। যেমন, লেন্ডিং সার্ভিস, জেনারেল রিডিং ফেসেলিটি, গাইডেন্স সার্ভিস সেন্টার,রেফারেন্স সার্ভিস, ফ্রি নিউজ পেপার রিডিং সার্ভিস,সিনিয়র সিটিজেন সেকশন,নিউ লিটারেট,রিপ্লোগ্রাফি সার্ভিস,চিলড্রেন কর্ণার,ইউমেন সেকশন,জার্নাল এন্ড পিরিয়ডিক্যাল সেকশন ল Stand ও ব্রেইলি সেকশন। ১৩টি সুবিধাযুক্ত হলেও তাতে তেমন কেউ আসতে চাইছেন না। তিনি আরো জানান, একসময় এখানে সর্বভারতীয় অনেক পত্রিকা আসতো। এখন শুধুমাত্র রাজ্যের দুএকটি পত্রিকা আসে। জেলা গ্রন্থাগার পরিচালনার জন্যে কমপক্ষে ৬ জন কর্মচারীর প্রয়োজন। বর্তমানে আছেন মাত্র ৩ জন। গত কয়েকমাস আগে জেলার ফটিকরায়ে গ্রামীন পাঠাগার খোলার পর এখান থেকে একজন কর্মচারীকে বদলী করে নিয়ে যাওয়া হয়। তবে একজন অস্থায়ী সাফাই কর্মীকে স্থায়ী করে দপ্তর। তবে দীর্ঘসময় ধরে নৈশ প্রহরী নেই এই গ্রন্থাগারে। লক্ষ লক্ষ টাকার সামগ্রী এখানে থাকলেও রাতে পাহাড়ার কোন ব্যাবস্থা নেই ।
মানুষের মধ্যে বই পড়ার আগ্রহ বাড়ানোর লক্ষ্যে দপ্তরের তরফে জেলার স্কুল কলেজ ও এনজিও-র সাথে যোগাযোগ করে ‘পাঠক সচেতনতা কর্মসূচী’ শুরু হয়েছে। তাতে সামান্য হলেও সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। তবে পাঠকের চাহিদা থাকলেও সমস্যা হচ্ছে সর্ব ভারতীয় কোন পত্র পত্রিকা এখানে আসে না। একই সাথে এমপ্লয়মেন্ট নিউজ পেপার আগের মতো আসে না। যদিও বা আসে তা দেখা যায় ইন্টারভিউর সময় চলে গেছে। এই অবহেলাও এক ধরণের পাঠকদের দূরে ঠেলে দিয়েছে।
গ্রন্থাগারটিতে কমী স্বল্পতা রয়েছে তেমনি বইয়ের পাঠকের সংখ্যা কমে যাওয়ায় অপুষ্টির শিকার হচ্ছে। আবার সরকারি উদাসীনতায় দৈন্যদশায় পরিণত হয়েছে জেলাসদরের একসময়ের ঐতিহ্যপূর্ণ এই গ্রন্থাগারটি। গ্রন্থাগারের অবস্থা এখন প্রকৃত অর্থে পরিবেশ বান্ধব নয়। গ্রন্থাগার থেকে মানুষের মুখ ঘুরিয়ে নেওয়ার এটাও একটা কারণ । ঊদাসীনতা কী পরিমাণ রয়েছে তা অনুমান করার জন্য জেলা গ্রন্থাগারের ভেতরে প্রবেশ করার দরকার নেই। ঐতিহ্যবাহী এই গ্রন্থাগারের প্রবেশ পথের দু’পাশে বাঁশের সারি। বাঁশ ব্যবসায়ীরা দাপটের সাথে বাঁশ বিক্রি করছেন। জেলা গ্রন্থাগারের অবয়ব ঢেকে পড়ছে বাঁশের সারিতে। না প্রশাসন না পুর পরিষদের নজর রয়েছে এই পরিবেশের দিকে। অনেক সময় এই গ্রন্থাগারের সভাকক্ষে সরকারী উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক হয়। কিন্তু প্রবেশ পথের এই দৃশ্য শহরবাসীকে লজ্জায় ফেলে দেয়।