মনু নদীর তীরবর্তী শহর কৈলাসহর। একদিকে নদী আর অন্যদিকে জল নিষ্কাশনের পরিকল্পিত ব্যবস্থা না থাকার কারণে শহরের বুক ভাসতো বন্যার জলে। নদীর জল বাড়লেই শহরবাসীর ত্রাহি ত্রাহি রব শুরু হত। ফরেস্ট অফিস থেকে শুরু করে পশ্চিমাবাজার এলাকায় নদীর জল উপচে পড়ত। বালির বস্তা দিয়ে সেই জল আটকানোর চেষ্টা করা হত। অন্যদিকে লক্ষীছড়ার জল গিয়ে পড়ে মনু নদীতে। মনুর জল বাড়লে ছড়ার জলও বেড়ে যায়। জল ঢুকে পড়ে শহরের দিকে। এভাবে বর্ষার দিনে বন্যায় ভেসে যাওয়ার আতঙ্কে কাটত শহরবাসীর। অন্যদিকে পাইতুরবাজার থেকে চিরাকুটি পর্যন্ত বৃষ্টির জমা বুক জলে বন্দী হয়ে পড়তেন ঐ এলাকার মানুষ। বলা যায় লক্ষীছড়া সেতু থেকে নৌকা করে চিরাকুটি পর্যন্ত যাতায়াত করতে হত। অন্যদিকে কৈলাসহরের শস্যভাণ্ডার বলে পরিচিত হাওর অঞ্চল এলাকায় প্রতিবছর বন্যার জলে কৃষকের ফসল নষ্ট হয়ে যেতো। তাই মনু নদী হয়ে উঠেছিল কৃষকদের দুঃখের কারণ। প্রথম বামফ্রন্ট সরকারের তৃতীয় বছর ১৯৮০ সাল বৈদ্যনাথ মজুমদার পূর্ত ও পরিবহন মন্ত্রী। শহরকে এবং হাওর অঞ্চলকে বন্যার হাত থেকে বাঁচানোর জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। শহরের পশ্চিùম দিকে যেখানে নদীর জল ঢুকে পড়ত সেই জায়গাজুড়ে প্রায় আট ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট পাকা বাঁধ নির্মাণ করেন। সেই বাঁধ ক্রমশ বিস্তার হতে হতে শহরকে ঘিরে ফেলে। ঠিক একই ভাবে লক্ষীছড়ার উভয় পাড়ে বাঁধ তৈরি করে বন্যার হাত থেকে শহরকে নিরাপদ রাখা হয়। অন্যদিকে ইছবপুর গ্রামের প্রবেশ মুখে সাইফন তৈরি করে পাইতুরবাজার সহ বিস্তীর্ন এলাকার জমাট জলকে নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা হয়। সেই থেকে শহর ও শহরতলী এলাকা বন্যার আতঙ্ক এবং জল বন্দীর দুর্দশা থেকে মুক্তি পান। আর এই পরিকল্পনার প্রধান রূপকার ছিলেন বৈদ্যনাথ মজুমদার।
বাঁধ নির্মাণ হলেও তিনটি জায়গায় নদী এবং বাঁধের ভাঙন অথবা চোরা ফাটল উদ্বেগের কারণ। বিমানবন্দরের দক্ষিণ দিকে নদীর পাড়ে যে বাঁধ রয়েছে সেই জায়াগার মাটি নরম হওয়ার ফলে বাঁধ নেমে যায় কোথাও কোথাও নদীর ভাঙনের বিস্তার ঘটে।

এই অবস্থায় ২০০৭ সালে বিশেষ উদ্যোগ নিয়ে মাটি সংকোচনের ঘটনাগুলোকে নিয়ন্ত্রণে আনে জল সম্পদ দপ্তর। ২০১৮ সালের বন্যার সময় সেই জায়গা অলক্ষ্যে ব্যাপক ভাঙন দেখা দেয় । যার পরিণতি পাইতুরবাজার সহ বিস্তীর্ণ অঞ্চল প্রায় ছয় ফুটের মত জল উঠে যায়। ব্যাপকতম ক্ষতি এর আগে কোন দিন হয়নি। প্রায় দুই কোটি টাকা ব্যয়ে বাঁধ পুন সংßñার করা হয়। পেভার ব্লক বসানো হয় বাঁধের উপর।
এর আগে পিচঢালা পথ হয়েছিল এই বাঁধ। পেভার ব্লক বসানোর উদ্দেশ্য হলো কোন জায়গা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও তা দ্রুত মেরামত করা যাবে। কিন্তু এই বাঁধের উপর দিয়ে যে প্রতিদিন একাধিক ভারী লরি এই বাঁধের উপর দিয়ে নদী থেকে বালি নিয়ে যাচ্ছে। ফলে বাঁধের উপর চাপ পড়ছে। ভূতপূর্ব জেলা শাসক বিশাল কুমার বালি ভর্তি লরি ও জেসিপি একবার বাজেয়াপ্ত করে জেলা শাসক অফিসে নিয়ে যান। তারপর কিছুদিন বালির খাদান বন্ধ থাকলেও বর্তমানে যে কে সেই। ব্যক্তিগত ব্যবসায়িক মুনাফা সামনের দিনে কৈলাসহরে চরম বিপদ ডেকে আনবে। কার অঙ্গুলি হেলনে এই ব্যবসা চলছে তা দেখেও প্রশাসন নির্বিকার। তাই এ সম্পর্কে উদাসীন থাকা কিংবা সরব প্রতিবাদ দরকার। দুর্ঘটনা ঘটার আগেই প্রশাসনকে হস্তক্ষেপ করতে হবে। আর যদি তা না করা হয় তাহলে ২০১৮ সালের পুনরাবৃত্তি হবে। আর যদি তাই হয় তাহলে ভয়ঙ্কর বিপদে পড়বে ঊনকোটি জেলা সদর। কেননা প্রতিবছর বন্যার সময় বাংলাদেশের বাঁধ ভেঙে কৈলাসহরের জল বাংলাদেশে চলে যায়। এবছর বাংলাদেশের দিকে বাঁধ শক্তপোক্ত ভাবে মেরামত করা হয়েছে। বাঁধও উচু করা হয়েছে। ফলে মনুনদীর বাঁধগুলোকে যদি সংস্কার প্রয়োজনে উচ্চতা না বাড়ালে বিপদ চরমে পৌঁছবে।