রমেন্দ্র গোপ, খোয়াই –
বিজ্ঞান প্রযুক্তির অভাবনীয় অগ্রগতির যুগেও যে কিছু মানুষ সুপ্রাচীন সভ্যতা সংস্কৃতি আর সনাতনী গ্রামীণ ঐতিহ্যকে এখনো মনেপ্রাণে অন্তরে ধারণ করে চলেছেন তার সর্বোৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত হলো খোয়াই জেলার কল্যাণপুর ব্লকের রজনী সর্দার পাড়া এ ডি সি ভিলেজের গয়াঙফাঙয়ের উপজাতি কাষ্ঠশিল্পীদের শিল্পকর্ম। ওরা এখনো সুপ্রাচীন কৃষ্টি সংস্কৃতি আর গ্রামীণ শিল্পকর্মকে আন্তরিকভাবে লালন করে চলেছেন। দিনকয়েক বাদেই পৌষ পার্বন। অর্থাৎ দোড়গোড়ায় কড়া নাড়ছে আনন্দের পিঠেপুলির উৎসব। জাতি উপজাতির সব মানুষের ঘরে ঘরে যার যার সাধ আর সাধ্য অনুসারে রকমারী পিঠেপুলির ব্যবস্থা তো হবেই। আর শীতের সকালে লালিগুড় দিয়ে মাখানো বিচিত্র স্বাদের সব বাহারী পিঠেপুলির স্বাদে রসনা তৃপ্তির মজাটাই তো আলাদা এক অনুভূতির মতো। পিঠেপুলি তো হবেই। কিন্তু চালের গুঁড়ো কে করে দেবে! এখন তো আর চালের গুঁড়ো সেই প্রাচীন যুগের মতো গাইল ছিয়ায় হয়না। পৌষ পার্বনের আগের দিন সাতসকালে মানুষ ছুটে রাইস মিলে। অর্থাৎ চালের কলে।সেখানেই আলাদা কলে চাল থেকে তৈরি হয় গুঁড়ো। আর সেই গুঁড়ো দিয়ে পৌষ সংক্রান্তিতে নারিকেলের কণ্ডা মিশিয়ে তৈরি হবে মালপোয়া, পাটিসাপটা সহ আরো কত কী!কিন্তু এখনো অনেকেই চালের গুঁড়োর জন্য ছুটেন গ্রামীণ পাড়া মহল্লার সেকেলে আমলের বাড়ীতে। সেসব বাড়ীতে এখনো গাইল ছিয়ায় তৈরি হয় পৌষ সংক্রান্তির চালের গুঁড়ো।
আর সেই চালের গুঁড়ো দিয়ে তৈরি হবে পিঠেপুলির বিস্তর সমাহার। গ্রামেগঞ্জে এখনো অনেকেই রাইস মিল বা চালের কলের গুঁড়ো দিয়ে পিঠেপুলি বানানো পছন্দ করেন না। রাইস মিলের চালের গুঁড়ো দিয়ে বানানো পিঠে নাকি ভালো লাগে না অনেকের কাছেই। গ্রাম ত্রিপুরার লালিত সংস্কৃতিই হলো গাইল ছিয়ায় পৌষ সংক্রান্তির সময় চালের গুঁড়ো তৈরি করে মনের সুখে মা মাসিদের পিঠেপুলি বানানো। আবহমান কাল থেকেই চলে আসছে সেই ঐতিহ্য আর কৃষ্টি সংস্কৃতি । আর সেই সুপ্রাচীন ঐতিহ্যকেই হৃদয়ে লালন করে চলেছেন এখনো অনেক মানুষই। আর তাই এখনো গ্রামেগঞ্জে পৌষ পার্বনের সময় গাইল ছিয়ার খোঁজ করে মানুষ। কাঠের তৈরি গাইলের মধ্যে চাল ফেলে দিয়ে কাঠের তৈরি করা ছিয়া বা স্যাকাইট দিয়ে গাইলে থাকা চালে একের পর এক ঠোকা দিয়ে গুঁড়ো তৈরি করা হয়। তাই এখনো গাইল ছিয়ার কদর একেবারেই শেষ হয়ে যায়নি। কদর কমেছে যদিও অনেকটা। কিন্তু গাইল ছিয়ায় ব্যবহার এখনো চলছে গ্রামেগঞ্জের জনপদে। জাতি উপজাতি উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ এখনো গাইল ছিয়া ব্যবহার করে চলেছেন সমানে। আর তাই খোয়াই জেলার কল্যাণপুর ব্লকের রজনী সর্দার পাড়া এ ডি সি ভিলেজের গয়াঙফাঙ এলাকার উপজাতি কাষ্ঠশিল্পীরা এখনো কাঠ দিয়ে তৈরি করেন গাইল আর ছিয়া। কিছু মানুষ কেনেন এই গাইল ছিয়া। পনেরোশো ষোলশো টাকায় বিক্রি হয় এই গাইল ছিয়া। কল্যাণপুরের রজনী সর্দার পাড়ার উপজাতি কাষ্ঠশিল্পীরা এখন কাঠ দিয়ে তাই গাইল ছিয়া বানানোর কাজে ব্যস্ত। কারণ সামনেই পৌষ পার্বন । মানে ঐতিহ্যের পৌষ সংক্রান্তি। তাই গাইল ছিয়া বাজারে তুললে কিছু না কিছু তো বিক্রি করা যাবেই। রজনী সর্দার পাড়ার উপজাতি কাষ্ঠশিল্পীদের ঘরে ঘরে তাই গাইল ছিয়া বানানোর ধুম চলছে এখন। সভ্যতার অগ্রগতির যুগে যন্ত্রের ব্যবহার যতই বাড়ুক গাইলের মতো সাবেকি ঘরানার জিনিস আজো গ্রাম ত্রিপুরার মানুষের ঘর থেকে চিরদিনের মতো হারিয়ে যায়নি। কল্যানপুরের রজনী সর্দার পাড়ার গয়াঙফাঙয়ের উপজাতি কাষ্ঠশিল্পীরা সেই সুপ্রাচীন ঐতিহ্যকেই বুকে ধারণ করে চলেছেন। দু পয়সা কামাইও করা যায় এতে অভাবের সংসারে। আবার পুরোনো সনাতনী গ্রামীণ কৃষ্টির পৃষ্ঠপোষকতার ব্যাতিক্রমী অনুভব অনুভূতিও উপলব্ধি করা যায়।
কল্যানপুরের রজনী সর্দার পাড়ার গয়াঙফাঙয়ের উপজাতি কাষ্ঠশিল্পীরা জানান, বহুদিনের পুরোনো পেশা আমাদের । বাপ ঠাকুর্দাও কাঠমিস্ত্রি ছিলেন।আমাদের পারিবারিক পেশা।পৌষমাসের পরব এলে গাইল ছিয়া বানানোর নেশায় মাতাল হয়ে যাই। সব মানুষ যে এখনো কদর করেন গাইল ছিয়ায় পৌ¡তা নয়। তবে এখনো কিছু মানুষ গাইল ছিয়ায় তৈরি চালের গুঁড়োয় পিঠেপুলি খেতে পছন্দ করেন।তাই কষ্ট করে বানালে কিছু তো বিক্রি হয়েই যায়। গয়াঙফাঙয়ের উপজাতি কাষ্ঠশিল্পীরা জানান, কাঠ দিয়ে গাইল বানানো খুব কষ্টের কাজ। পরিশ্রম হয় বেশী। তবু বানাই। জানিনা আমাদের ছেলেপুলেরা এই কাজ করবে কিনা! শেখানোর চেষ্টা করছি। কিন্তু আজকের দিনের ছেলেপুলেরা এসব কাজে আগ্রহ খুবএকটা দেখায়না।
