প্রলয়েন্দু চৌধুরী
আদিম মানব সমাজে যখন হাত পা মুখের আশ্রয় ছেড়ে দিয়ে ধারালো পাথর ছুঁড়ে শিকার মারল সেদিনই মানুষ প্রকৃতির উপর নিয়ন্ত্রণের অধিকার অর্জন করলো। প্রকৃতিকে ব্যবহার করেই প্রয়োজন মত সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের জীবন যাপনে অভ্যস্ত হল। প্রয়োজন ও সুখের সঙ্গে যেদিন লোভ যুক্ত হল সেদিনই প্রকৃতির ভারসাম্যে চরম আঘাতের শুরু । জৈব বৈচিত্র, জীব ও তার পরিবেশের পারস্পরিক আন্তঃসম্পর্ক চরমভাবে ব্যাহত হল। প্রকৃতির শৃঙ্খলা ভেঙে দুমড়ে মুচড়ে গেল। তার থেকেই নানা বিপর্যয় সমূহ আজ বিশ্ব জুড়ে উৎকন্ঠা ও উদ্বেগের বিষয়।
ঊনবিংশ শতাব্দীর সেই শিল্প বিপ্লবের পর থেকেই দুনিয়া জুড়ে মানব সমাজের জীবনযাত্রাকে সহজতর ও সাচ্ছন্দ্য যোগাতে সরকারী বেসরকারী পর্যায়ে ধারাবাহিক উন্নয়ন চলে আসছে । এই উন্নয়ন হয়েছে প্রকৃতিকে আঘাত করেই। জৈব বৈচিত্র্যকে ভেঙে চুরমার করে দিয়েই। প্রকতির ভারসাম্য ভেঙে পড়ায় বিংশ শতাব্দীতে এসে পরিবেশ বিজ্ঞানীরা প্রমাদ গুণলেন, উৎকন্ঠিত হলেন। চাই Sustainable Development বাংলায় যাকে বলে ‘টেকসই উন্নয়ন’। অর্থাৎ প্রকৃতিকে রক্ষা করে পুনর্নবীকরণের মাধ্যমে উন্নয়ন।
ত্রিপুরা ভৌগলিক দিক দিয়ে ছয় ঋতুর তেরো পার্বনের অঞ্চল। আজ প্রায় তিন দশক ধরে তেরো পার্বন থাকলেও ছয় ঋতু নেই। গ্রীষ্ম বর্ষা আর শীতের মধ্যে থেমে গেছে কালের গণ্ডি। জলবায়ু পরিবর্তন আর ভূ-উষ্ণায়নে আজ ত্রিপুরা বিচ্ছিন্ন নয়। ভৌগলিক মানচিত্রে বর্তমান ত্রিপুরা এক সময় বলা হত পার্বত্য ত্রিপুরা। যোগাযোগের প্রধান পথ ছিল নদী পথ। তাই সভ্যতার নিয়ম অনুযায়ী ত্রিপুরায়ও নদী বন্দর ভিত্তিক নগর বা শহর গড়ে উঠে। গড়ে উঠে বাণিজ্য কেন্দ্র। জলপথে সারা বছর পণ্য পরিবহন সহ যাত্রী পরিবহন হত। এ থেকে অনুমান করা যায় ত্রিপুরার নদীগুলো সারাবছর বুক ভরা জল থাকত।
কয়েক দশকে বদলে গেছে ত্রিপুরা। জল পথ হারিয়ে গেছে। নদীগুলোর নাব্যতা কমে গেছে। শুখা মরসুমে নদীর জলে ছোট ছোট শিশুরা খেলে বেড়ায়, শিশুরাই যেন নদীকে শাসন করে। আবার বর্ষাকালে নদীর ভয়াল ভয়ঙ্কর রূপ সর্বনাশা হয়ে উঠে। এর পেছনেও জৈব বৈচিত্র্য ভেঙে পড়ার অন্যতম কারণ।
সম্প্রতি ভারত সরকারের বন দপ্তরের একটি রিপোর্ট আমাদের দেখাচ্ছে ত্রিপুরায় ১৯৯৬-৯৭ সালে পাওয়ার গ্রীড এর লাইন সম্প্রসারনের জন্য করিডোর তৈরী করতে ১০০০ থেকে ১২০০ গাছ কাটা হয়। টাওয়ার বসানোর সময় প্রায় ২০০ থেকে ৩০০টি গাছ কেটে নেওয়া হয়। এছাড়া টাওয়ার এর স্থান পর্যন্ত সড়ক নির্মাণে বৃক্ষ, গুল্ম বৃক্ষ উপড়ে ফেলা হয়। একই ভাবে ২০১৯-২০২১ সালে এই তিন বছরের বন নিধনের হার ০.৪৩ শতাংশ। ২২.০৩ বর্গ কিলোমিটার। যদি আমরা এর গড় ঘনত্ব নিয়ে হিসাব করি তাহলে দেখা যাবে প্রতি হেক্টরে ১০০০ গাছ (সংরক্ষিত হিসেব অনুযায়ী) হয়। তাহলে ২২.০৩ বর্গ কিমি X ১০০ হেক্টর গু ২,২০৩ হেক্টর । অর্থাৎ ২,২০৩ হেক্টর X ১০০০ গাছ ২,২০৩,০০০ গাছ নিধন হয়েছে এই তিন বছরে। এই গাছগুলোর মধ্যে রয়েছে শাল, টিক, বাঁশ, আগর এবং বটবৃক্ষ। ঔষধি বৃক্ষ অশ্বগন্ধা, কলিহারি, সর্পগন্ধা। বিভিন্ন ফলদায়ী গাছ যেমন – কমলা, কাঁঠাল, আম। অন্যান্য গাছের মধ্যে রয়েছে ফার্ন,অর্কিড, বিভিন্ন প্রজাতির বাঁশ। এছাড়া রয়েছে ভেটিভার গ্রাস,এলিফেন্ট গ্রাস।
এই বৃক্ষ নিধন বা বনধ্বংসের বহুবিধ কারণ রয়েছে। কৃষি জমির সম্প্রসারণ, নগরায়ন, জনসংখ্যা বৃদ্ধি। আইনী বেআইনী পথে কাঠ ব্যবসা, জ্বালানী, অন্যান্য বনজ সম্পদের ব্যবসা, পরিকাঠামো উন্নয়ন, ত্রুটিয্ক্তু বন সংরক্ষণ, স্থানীয় গরিব বাসিন্দাদের জ্বালানী কাঠ সংগ্রহ করে জীবনধারণ। সর্বোপরী জলবায়ু পরিবর্তন বন ধ্বংসের ইন্ধন যোগাচ্ছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাইশ লক্ষ তিন হাজার গাছ ধ্বংসের হিসাব পেলাম। কিন্তু এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে নানা জীবজন্তুদের বসবাস। সেই প্রাণীকূলের অপরিমেয় ক্ষতি আমাদের দৃষ্টির বাইরে চলে যায়। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। যেমন – একটি বটগাছ। বিশাল ছায়া দেয়। আবার বহুবিধ কীট পতঙ্গ, প্রাণীদের আশ্রয় স্থল।

কীটপতঙ্গ : এই বটগাছে মৌমাছি, পিঁপড়া, প্রজাপতি, ভিমরুল ইত্যাদি ৩০০ প্রজাতির কীট পতঙ্গের আশ্রয় স্থল।
পাখি : টিয়া, হর্ণবিল, ঈগলের মত প্রায় ১০০ প্রজাতির পাখির বাসস্থান বটগাছ।
ছোট স্তন্যপায়ী বাদুড়, কাঠবেড়ালী, বাঁদর।
সরিসৃপ : সাপ টিকটিকি, ব্যাঙ, কটকটে ব্যাঙ।
সব মিলে স্থান কাল ভেদে একটি বটগাছ ১০০০ এর বেশি প্রজাতির প্রাণী ও কীট পতঙ্গের আশ্রয় স্থল। আবার গাছের প্রজাতির হেরফেরে প্রাণীদের আশ্রয় হয়। একই গাছে সব প্রাণী থাকে না। যেমন : গর্জন গাছে-ঈগল, কমলা রঙের মাথাওয়ালা থ্রাস, মেনগ্রোভ পিটা। কীট পতঙ্গের মধ্যে মেনগ্রোভ প্রজাতির মৌমাছি, স্থলচর কুমির, বন্য বিড়াল (ফিসিং ক্যাট)। শাল গাছে – হর্ণবিল, এটলাস মথ, জায়েন্ট লিপার্ড মথ প্রভৃতি। বাঁশ গাছে আশ্রয় নেয় মুনিয়া, বুলবুল, জায়েন্ট পাণ্ডা, রেড পাণ্ডা, এশিয়াটিক ব্ল্যাক বিয়ার প্রভৃতি। এভাবে প্রতিটি গাছের মধ্যেই কোন না কোন জীবদের বসবাস রয়েছে। যাদের দ্বারা জৈববৈচিত্র, খাদ্য শৃঙ্খল রক্ষা করে পরিবেশ বান্ধবের কাজ করে যায়। বন ধ্বংসের ফলে এই জৈব বৈচিত্র যেমন ভেঙ্গে পড়ে তেমনি পরিবেশও ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
উপরে উল্লেখিত গাছগুলোর মধ্যে ত্রিপুরায় জল সংরক্ষণে বিশেষ কার্যকরী ভূমিকা পালন করছে তার মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির বাঁশ, ঘাস । যার ফলে মাটির জলস্তর রক্ষিত হয়। নদী, নালা, লেক প্রভৃতির জল পর্যাপ্ত থাকে, মাটির আদ্রতা রক্ষা করে। আবার ভূমি ক্ষয় রোধে কার্যকরী ভূমিকা নিচ্ছে এই সব গাছগাছালি।
ব্যাপক হারে বৃক্ষ নিধনের ফলে যে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে রাজ্য তাহল – পানীয় জল, কৃষি ও শিল্পে জলের সংকট । প্রভাব পড়ছে শস্য ফলনে, যার পরিণতিতে বিঘ্নিত হবে খাদ্য নিরাপত্তা। যে ত্রিপুরার নদীগুলোতে সারা বছর বুক ভরা জল থাকত। আজ নাব্যতা কমে জলস্তর সারা বছর সমান থাকে না। হেমন্তের পর হাঁটু জলে নেমে যায় নদীগুলোর গড় নাব্যতা। আবার ভারি বর্ষনে প্রবল মত্ত হয়ে জলস্ফীতি অববাহিকাকে ব্যাপক ক্ষতি করে দেয়। ভূমি ধ্বসের ব্যাপকতা বৃদ্ধি পায় মৌসুমী বায়ুর মরশুমে। জৈববৈচিত্র ও বাস্তুতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সর্বোপরী অতি বন্যা এবং অতি খরার মুখোমুখি হচ্ছি আমরা।
প্রয়োজনে এবং অপ্রয়োজনে ত্রিপুরায় যে পরিমান গাছ কাটা হয়েছে তার ফলস্বরূপ ত্রিপুরাকে বড় ধরণের বিপর্যয়ের মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। যেমনটা ২০২২ সালে আমরা দেখেছি আসামে প্রবল বন্যায় পাহাড় ভেঙ্গে পড়েছে, রেলপথ নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে। পরিবেশ বিজ্ঞানীরা দায়ি করেছে ব্যাপক হারে বন ধ্বংসকে। এখন শুধুমাত্র আইন করে বা সরকারীভাবে বন সংরক্ষণ, বনায়ন সম্ভব নয়। চাই জৈব বৈচিত্র, জীব ও পরিবেশের পারস্পরিক আন্তঃ সম্পর্ক নিয়ে জন সচেতনতা।
তবে শুধু হতাশা নয়— আশার আলো একই সঙ্গে উঁকি দিচ্ছে। ইদানীং সরকারী বেসরকারী পর্যায়ে বনায়নের কর্মসূচী বেড়েছে। পাঁচ মিনিটে লক্ষ গাছ লাগানোর সরকারী পরিকল্পনা এবং তার ধারাবাহিক পরিচর্যা যদি থাকে তাহলে সত্যিকারের সম্ভাবনাময় বসুন্ধরা আবার পরিপূর্ণ হবে- ফলে-ফুলে-শস্যে-ফসলে। জীব জগতও হয়ে উঠবে প্রাণবন্ত ।
কোভিড আমাদের দেখিয়েছে প্রকৃতিকে উপেক্ষা করার পরিণতি কি হতে পারে। যে গাছ আমাদের অক্সিজেন দেয় তাই আমাদের জীবনের অমূল্য প্রাণবায়ু। আর এই প্রাণীবায়ু ছাড়া প্রাণী জগৎ অচল। অথচ আমরা অবলীলায় সেই গাছকে নির্মমভাবে কেটে ফেলছি। উন্নয়নের নামে সবুজকে ধ্বংস করে ঘন জঙ্গলের পরিসীমা সঙ্কুচিত করছি। জীবাণুদের আস্তানায় আঘাত করার কারণে সেই জীবাণু মানুষের বসতিতে চলে আসে। এরফলে শতাব্দির পর শতাব্দি নানারকমের সংক্রমণে আক্রান্ত হচ্ছে মানব সভ্যতা। পরিবেশ ও স্বাস্থ্য বিজ্ঞানীরা
আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন কোভিড নামক মহামারী সে রকমই ছিন্নমূল জীবাণুর
আক্রমণ। এই মহামারীর সময় আমরা প্রত্যক্ষ করলাম বিশ্বব্যাপী শুধু মাত্র অক্সিজেনের অভাবে লক্ষ লক্ষ লোক মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছেন। গো-গ্রীনভলান্টিয়ার্স বর্ষব্যাপী অসাধারণ কাজ করেছেন। যে দৃষ্টান্ত তাঁরা তৈরী করেছেন প্রশংসা বা ধন্যবাদ নয়, তার চাইতেও আরও বেশি কিছু প্রাপ্য তাঁদের। আমরা জানি মানুষ স্বেচ্ছায় রক্তদান করেন, যার পেছনে কোন স্বার্থ জড়িয়ে নেই। বিশেষ করে শিবিরে যে রক্তদাতা রক্ত দান করেন তিনি জানেনই না তাঁর রক্তে কোন মুমূর্ষু রোগী প্রাণ ফিরে পেলেন। এ হচ্ছে মানুষ হিসেবে মানুষের পাশে দাঁড়াবার দুর্নিবার আকাঙ্খা।
গো গ্রীনের ভলান্টিয়ার্স একইভাবে প্রাণবায়ুকে সচল রাখতে বছরব্যাপী গাছ লাগাচ্ছেন নিঃস্বার্থভাবে।
আবার তাদের সদ্য লাগানো গাছকে উপরে ফেলে সমাজের হিংস্র চোহারাটা বিচ্ছিন্নভাবে মাঝে মাঝে উঁকি দেয় । জীবনমুখী একটি কর্মসূচী কেন আক্রান্ত হবে তার উত্তর মেলা ভার। গো গ্রীনের সদস্যরা হতাশ না হয়ে ফের গাছ উপড়ে ফেলার জায়গাতেই বৃক্ষরোপন করেন। তাদের জেদি মনোভাব নাগরিকদের বাহবা কুড়োয়।
তবে উদ্যোগকে আরো এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে স্কুল পড়ুয়াদের নিয়ে সচেতনতামূলক আলোচনা, কর্মশালা
গো-গ্রীন ভলান্টিয়ার্স যদি করতে পারে তাহলে তার সুদূর প্রসারী ফল মিলবে। আজকের ছাত্র আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। এই ছাত্ররাই প্রকৃতিকে বাঁচানোর বার্তা নিয়ে যেতে পারে ভাবীকালের কাছে।
Picture Courtesy : Go Green Volunteers album
